অ্যালঝেইমার ডিজিজ ঃ

আলঝেইমারস রোগ আলঝেইমারস একটি মারাত্মক ও ক্রনিক (দীর্ঘস্থায়ী ও অনিরাময় যোগ্য) রোগ, যা মস্তিষ্ককে আক্রমণ করে এবং ধীরে ধীরে কর্মক্ষমহীন করে ফেলে। এটি একটি অধিকতর খারাপের দিকে অগ্রসর হওয়া রোগ, যার প্রক্রিয়া ৫ থেকে ২০ বছর ধরে চলতে থাকে এবং এমন একটি সময় আসে যখন এই রোগীরা তাদের প্রত্যাহিক সব কাজের (যেমন খাওয়া, গোসল করা ও বাথরুম ব্যবহার করা) জন্য অন্যের ওপর সার্বক্ষণিক নির্ভরশীল হয়ে পড়েন। সুতরাং রোগীর পরিবার বা দেখাশুনাকারীর ওপর এই রোগের মানসিক প্রভাব অনেক বেশি। প্রতি বছর ১ লাখ মানুষ এ রোগে আক্রান্ত হয় এবং বড়দের মৃত্যুর চতুর্থ প্রধান কারণ এই রোগ। রোগের কারণঃ আলঝেইমারস রোগের নির্দিষ্ট কোনো কারণ জানা যায়নি। তবে এটা কোনো সংক্রামক ব্যাধি নয়। নিম্নোক্ত কিছু   কারণ এই রোগের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেঃ ১. বয়সঃ বয়সই এ রোগের সবচেয়ে সুষ্পষ্ট ও প্রধান কারণ। ৬৫ বছর বয়সের ওপরের শতকরা ৫ শতাংশই এ রোগে আক্রান্ত হন। যদিও ৮৫ বছরের ওপরে শতকরা ৫০ শতাংশরই এ রোগ আছে। কখনো কখনো এই রোগ অল্প বয়সেও হতে পারে। সব রোগীর মধ্যে ১-১০ শতাংশর অল্প বয়সে শুরু হয়েছে। ২. জেনেটিক কারণঃ বংশগত ফ্যাক্টরও আলঝেইমারস রোগের একটি গুরুত্বপূর্ণ কারণ। যে রোগীদের কোনো না কোনো আত্মীয়ের এ রোগে আক্রান্ত, তাদের বলা হয় Familial Alzheimer’s Disease. আবার যাদের কোনো আত্মীয়ই এ রোগে আক্রান্ত নয়, তাদের ক্ষেত্রে বলা হয় Alzheimer’s Disease. উপসর্গ ১. স্মরণশক্তি লোপ পাওয়াঃ সাধারণত এই উপসর্গ দিয়েই রোগের শুরু হয়। আলঝেইমারস রোগীরা নিকট অতীতে ঘটে যাওয়া ঘটনাগুলো মনে করতে পারেন না। ২. ভুল জায়গায় জিনিসপত্র রাখা বা পরিচিত পরিবেশে নিজেকে হারিয়ে ফেলা। ৩.রোগ বাড়ার সাথে সাথে রোগীরা যেকোনো কিছু নিয়ে দ্বিধাদ্বন্দ্বে থাকেন, পারিপার্শিকতার সাপেক্ষে অসচেতন হয়ে পড়েন। ৪. এ ছাড়া অন্যান্য সাধারণ উপসর্গগুলোর মধ্যে আছে ব্যক্তিত্ব ও আচরণজনিত সমস্যা। যেমন, অস্থিরতা বা বিষণ্ন্নতায় ভোগা। ধীরে ধীরে লোপ পায় বিচারশক্তি ও সাধারণজ্ঞান। এক পর্যায়ে রোগী একেবারে সাধারণ কাজ যেমন চুল আচড়ানো, দাঁত ব্রাশ করাও ভুলে যান। এদের অনেকেই প্যারানয়েড ডিলিউশনে ভোগেন এবং নিজের পরিবারের সদস্যদের প্রতারক মনে করেন কিংবা নিজের অতিপরিচিত ঘরকেও অন্যের মনে করেন। ২০-৩০ শতাংশ রোগীর ক্ষেত্রে চলাফেরায় ধীরস্থিরতা চলে আসে। রোগ নির্নয়ঃ এমন কোনো পরীক্ষা নেই, যা দ্বারা জীবিত থাকা অবস্থায় এই রোগ সুনির্দিষ্টভাবে ডায়াগনোসিস করা যায়। একমাত্র মৃত্যুর পর ব্রেইন টিস্যু/কোষ নিয়ে পরীক্ষা করে এ রোগ সঠিকভাবে ডায়াগনোসিস করা সম্ভব। যখনই আলঝেইমারস রোগ সন্দেহ করা হবে, তখনই সম্পূর্ণ মেডিক্যাল ও নিউরোলজিক্যাল পরীক্ষা করা আবশ্যক। কেননা এমন কিছু চিকিৎসাযোগ্য রোগ (যেমন বিষণ্ন্নতা, হাইপোথাইরয়েডিজম, ভিটামিন বি-১২ এর অভাব, হাইড্রোকেফালাস, সেরিব্রাল ভাসকুলাইটিস, নিউরোসিফিলিস, এইডস, স্ট্রোক, অ্যালকোহল এবং কিছু ওষুধ) আছে যাদের উপসর্গগুলো আলঝেইমারস রোগের মতো কিন্তু তার সুচিকিৎসা আছে। চিকিৎসাঃ আলঝেইমারস রোগের সম্পূর্ণ নিরাময়যোগ্য কোনো চিকিৎসা নেই। তবে কিছু কিছু ওষুধ আছে, যা দিয়ে এ রোগের উপসর্গগুলোর চিকিৎসা দেয়া হয় কিন্তু এতে রোগের সম্পূর্ণ নিরাময় হয় না। তবে নতুন নতুন ওষুধ আবিষ্কারের জন্য বিভিন্ন ধরনের গবেষণা চলছে।   ডা. আলিম আক্তার ভূঁইয়া লেখকঃ কনসালট্যান্ট নিউরোলজিস্ট, এ্যাপোলো হাসপাতাল, ঢাকা দৈনিক নয়া দিগন্ত, ০২, মার্চ ২০০৮   আলঝাইমারঃ প্রবীণদের স্মৃতিভ্রংশ রোগ ডিমেনশিয়া। চিত্তভ্রংশ রোগ। প্রবীণদের এ রোগ এখন বেশ দেখা যায়। পুরো রোগকে বলা যেতে পারে আলঝাইমার রোগ। সারা পৃথিবীতে প্রবীণের সংখ্যা যেহেতু বাড়ছে, এ জন্য এসব রোগ নিয়ে বেশ কথাবার্তাও হচ্ছে। ঠিকমতো স্বাস্থ্যকর খাবার খাওয়ার, ব্যায়াম করার এবং শরীরের বাড়তি ওজন ঝেড়ে ফেলার অঙ্গীকার করছে অসংখ্য লোক। কেবল হৃদরোগ ঠেকানোর জন্য নয়, এখন বলা হচ্ছে এমন জীবন চর্চা করতে থাকলে আলঝাইমার রোগও অনেকটা ঠেকানো যাবে। কোন বুড়ো লোকের যে হবে কেউ জানে না-ডিমেনশিয়ার কাছে হারবে, না একে পরাভূত করবে, কেউ জানে না। বিজ্ঞানীরা জেনেছেন, সঠিক খাবার ও ব্যায়াম এবং ওজন নিয়ন্ত্রণ করলে হৃদরোগ, মস্তিষ্কে রক্তক্ষরণ ও রক্তবাহজনিত ডিমেনশিয়ার ঝুঁকি কমানো সম্ভব। যুক্তরাষ্ট্রের শিকাগোর আলঝাইমার সমিতির মেডিকেল ও সায়েন্টিফিক অ্যাফেয়ার্সের সভাপতি বিল থাইস বলেন, ‘গত তিন বছরে গবেষণার ক্ষেত্রে একটি তাৎপর্যপূর্ণ যে ফলাফল, তা হলো হৃদরোগের ঝুঁকি উপাদানগুলো আলঝাইমার রোগের ঝুঁকির একই পথে চলা।’ আরও বেশ কিছু মস্তিষ্ক পরীক্ষা করে দেখা গেল, যেসব লোকের হৃদরোগ ছিল, তাদের মস্তিষ্কে সেসব প্লাক ও স্মায়ুজট তিন গুণ বেশি দেখা যায়। ডা· স্পার্ক এখন কাজ করেন আরিজোনায় সান হেলথ রিসার্চ ইনস্টিটিউটে। তাঁর বক্তব্য, ‘সেসব লোক ৬০ বছর বয়সে হৃদরোগ জয় করে বেঁচে থাকলেও, ৮০ বছর পর্যন্ত বাঁচলে, এরপর তাদের হয়তো ডিমেনশিয়া ধরত।’ এখন এ কথা অনেক বিজ্ঞানীই বিশ্বাস করলেন না। তারপর দীর্ঘমেয়াদি এপিডেমিওলজিক্যাল নিরীক্ষাগুলোর ফলাফল আসতে শুরু করল। ১৯৯৬ সালে সুইডেনের গোটবর্গ বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন মনোবিজ্ঞানী ডা· ইগমার স্কুগ একটি গবেষণাপত্র প্রকাশ করলেন বিশ্বখ্যাত মেডিকেল জর্নাল ল্যানসেট-এ। বিষয় ছিল ‘৭০ বছর বয়সে উচ্চ রক্তচাপ হলে ১৫ বছর পর আলঝাইমার রোগ হওয়ার প্রবণতার মধ্যে সম্পর্ক’। বছরাধিককাল আগে উপরিউক্ত চাপ হলে কি আরও বৃদ্ধ বয়সে আলঝাইমার হওয়ার পথ প্রশস্ত করে দেয়? অন্যান্য গবেষকও এর উত্তরে ইতিবাচক তথ্যই দিলেন। ২০০০ সালে হনলুলু-এশিয়া এজিং নিরীক্ষায় জানা গেল, মধ্যবয়সী জাপানি-আমেরিকান লোক, যাদের ডায়াসটোলিক রক্তচাপ ৯০-এর বেশি, তাদের ২০-২৫ বছর পর আলঝাইমার রোগের আশঙ্কা পাঁচ গুণ বেশি; যাদের ডায়াসটোলিক চাপ ৮০-৮৯-এর মধ্যে, তাদের তুলনায় অবশ্যই। তাদের যদি উচ্চ রক্তচাপের চিকিৎসা করা যায়, তাহলে পরবর্তী সময় আলঝাইমার রোগের ঝুঁকি অনেক কমে যায়। গত তিন বছরে হৃদরোগের আরও কিছু ঝুঁকি উপাদান আলঝাইমার রোগের সঙ্গে সম্পর্কিত বলে জানা গেছে। সেগুলো হলো-ধূমপান, এথারোক্লেরোসিস, রক্তে উঁচু মানের কোলেস্টেরল, রক্তে হোমোসিসটিন নামে একটি পদার্থের উপস্থিতি। দুটো গবেষণায় দেখা গেছে, মাঝারি ধূমপান আলঝাইমার রোগের ঝুঁকি বাড়ায় দ্বিগুণ থেকে তিন গুণ। মেদস্থূলতাও একটি বড় ঝুঁকি বটে। সুইডেনে গোটবর্গ গবেষণায় দেখা গেছে, ৭০ বছর বয়সে বডি মাস ইনডেক্স (বিএমআই) এক পয়েন্ট বাড়লে ১৫ বছর পর আলঝাইমার রোগের ঝুঁকি বাড়ে ৩৬ শতাংশ। বড় আরও দুটি গবেষণায় দেখা গেছে, ভারী শরীরের সঙ্গে ডায়াবেটিস যুক্ত থাকলে আলঝাইমার রোগের ঝুঁকি বাড়ে দ্বিগুণ। ডিমেনশিয়া বা চিত্তভ্রংশের আশঙ্কা কমাতে চাইলে কী করতে হবে? শুভ সূচনা করুন হৃৎস্বাস্থ্যকর খাবার খেয়ে। বছর তিনেক আগে শিকাগোর বাশ ইনস্টিটিউট অব হেলদি এজিংয়ের মার্থা ক্লেয়ার মরিস একটি এপিডেমিওলজিক্যাল গবেষণা নিবন্ধ প্রকাশ করে দেখিয়েছেন, বয়স্ক লোক, যাঁরা সপ্তাহে অন্তত এক দিন মাছ খেয়েছেন, চার বছর পর তাঁদের আলঝাইমার রোগের ঝুঁকি কমেছে ৬০ শতাংশ। এর কার্যকারণ সম্পর্কে বলার সময় এখনো আসেনি। তবে মরিস বলেন, লক্ষ করা গেছে, মাছে রয়েছে একটি ওমেগা-৩-মেদ অ্ল, ‘ডিএইচএ’-এই পুষ্টি উপকরণ গ্রহণের সঙ্গে আলঝাইমার রোগের আশঙ্কা হ্রাসের একটি সম্পর্ক আছে। তিনি বলেন, ডিএইচএ হলো মস্তিষ্কের একটি মুখ্য চর্বি পদার্থ। আরেকটি গবেষণায় তিনি লক্ষ করেছেন, যাঁরা ভিটামিন-ই-সমৃদ্ধ খাবার বেশি গ্রহণ করেন, যেমন-উদ্ভিজ্জ তেল, গমের অঙ্কুর, গোটা শস্য, সূর্যমুখীর বীজ ও সবুজ সবজি-তাঁদের এ রোগের ঝুঁকি কমে ৭০ শতাংশ। আবার অন্যপক্ষে, যাঁরা সম্পৃক্ত চর্বি ও ট্যান্সফ্যাট বেশি গ্রহণ করেন, তাঁদের আলঝাইমার রোগের আশঙ্কা অনেক বাড়ে। হৃদরোগের ঝুঁকিগুলো যদি আমরা পরিহার করি, তাহলে এ রোগের আশঙ্কা কমবে সন্দেহ নেই, যদিও এগুলোর কার্যকারণ এখনো স্পষ্ট নয়। তবুও হৃৎস্বাস্থ্যকর জীবনচর্চা আরও বেশি করে করলে হৃৎপিণ্ড ও মস্তিষ্ক দুটোরই হিত হবে-এ হচ্ছে মোদ্দা কথা। শিল্পোন্নত দেশে আলঝাইমার রোগীদের পুনর্বাসন ও স্বস্তিকর জীবনের জন্য উদ্যোগ নেওয়া শুরু হয়েছে। এর একটি হলো এসব রোগীকে বাগান চাষে নিয়োজিত করা। বাগান চর্চা করলে কেবল আলঝাইমার রোগীদের জীবনের গুণগত মানই বাড়ে না, ডিমেনশিয়া থেকে মনে যে উদ্বেগ হয় এরও উপশম হয়। রোগীর মনমেজাজ ভালো হয়, বিশৃঙ্খল আচরণও হ্রাস পায়। ওয়াশিংটন ডিসির রিসার্চ ইনস্টিটিউট অন এজিংয়ের ডিরেক্টর জিসকা কোহেন মেনসফিল্ড ১৯৮৮ সালে এক গবেষণায় দেখিয়েছেন, যেসব রোগী নিয়মিত উদ্যানে আসে তাদের বিশৃঙ্খল আচরণ বদলে যায়, চনমনে হয় মেজাজ। তিনি বলেন, ‘উদ্যান পালন থেরাপিটি, যাঁরা জীবনে উদ্যান চর্চাকে অর্থবহ মনে করেছেন, তাঁদের জন্য খুবই উপকারী।’ এসব উদ্যান বিশেষভাবে নির্মিত হতে হবে তাঁদের জন্য। থাকতে হবে বেষ্টনী, যাতে রোগীরা উদ্যানের বাইরে হঠাৎ বেরিয়ে যেতে না পারেন। থাকবে একটি ঘূর্ণায়মান ঝরনা, সুবাসিত ও উজ্জ্বল ফুলের সমারোহ, ইংরেজি আট অক্ষরের আকারে নির্মিত পায়ে চলার পথ, যাতে রোগীরা পথে চলতে হারিয়ে না যায়। আর অনেক আলঝাইমার রোগীর জন্য উদ্যানে বারবার যাওয়া উসকে দিতে পারে অনেক মধুর ্নৃতি। আমরা তো জানি, ‘ফুলের বনে যার পাশে যাই, তারেই লাগে ভালো।’ পরিকল্পনাটি যদি ভালো লাগে, তাহলে আমরা কি এক হতে পারি এমন একটি থেরাপিউটিক গার্ডেন রচনার জন্য

মন্তব্যসমূহ

জনপ্রিয় পোস্টসমূহ