হেপাটাইটিস বি রোগের প্রতিরোধে ঃ

হেপাটাইটিস বি নিয়ে কথা লিভারের প্রদাহকে হেপাটাইসিস বলা হয়। স্থান-কাল পাত্রভেদে বিভিন্ন হেপাটাইটিস হতে পারে। যেমন—ভাইরাস, মদ্যপান বিপাকে অসংগতি ইত্যাদি। বাংলাদেশে সাধারণত ‘এ, বি, সি ও ই’ ভাইরাস দ্বারা লিভারের হেপাটাইটিস হয়ে থাকে। জন্ডিস দেখা দিলে এ রোগটি ধরা যায়, যদিও নিশ্চিত হওয়ার জন্য রোগীর রক্তে ভাইরাসের নির্দিষ্ট এন্টিজেন বা এন্টিবডি উপস্থিত থাকা প্রয়োজন। হেপাটাইটিস জন্ডিস হিসেবে বা জন্ডিস ছাড়াও ধরা পড়তে পারে। বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থার তথ্য অনুযায়ী, সারা বিশ্বে ২০০ কোটি মানুষ হেপাটাইটিস-বি দ্বারা আক্রান্ত, যার মধ্যে ৩৫ কোটি লোক হেপাটাইটিস-বি সংক্রান্ত, দীর্ঘস্থায়ী রোগে ভুগছে এবং প্রতিবছর এ সম্পর্কিত জটিলতায় ছয় লাখ লোক মারা যাচ্ছে। এই ভাইরাস এইডস ভাইরাসের সংক্রমণের ক্ষমতা ৫০ থেকে ১০০ গুণ বেশি। বাংলাদেশে হেপাটাইটিস-বি ভাইরাস দ্বারা আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা কত, এর জাতীয়ভিত্তিক পরিসংখ্যান না থাকলেও ব্যক্তিগতভাবে অনেক গবেষক এ সংক্রান্ত জরিপ চালিয়েছেন। গবেষক কর্তৃক নির্দিষ্ট জনগোষ্ঠীর ওপর পরিচালিত জরিপে দেখা যায়, বাংলাদেশের শিরায় নেশাগ্রস্তদের মধ্যে আট শতাংশ, পতিতাদের মধ্যে নয় দশমিক সাত শতাংশ, পেশাদার রক্তদাতাদের মধ্যে ২০ শতাংশ ও অপেশাদার রক্তদাতাদের মধ্যে পাঁচ দশমিক ছয় শতাংশ এ ভাইরাস বহন করছে। হেপাটাইটিস-বি দ্বারা আক্রান্ত বেশির ভাগ রোগীর দেহে ভাইরাসটি বাহক হিসেবে সুপ্ত অবস্থায় থাকে। কোনো ধরনের উপসর্গ দেখা দেয় না বলে এ সংক্রান্ত জটিলতা দেখা না দিলে রোগীরা সাধারণত চিকিৎসকদের শরণাপন্ন হন না। এ সংক্রান্ত রোগের ব্যাপকতা নির্ভর করে জীবাণুটি কখন শরীরে প্রবেশ করেছিল এবং ব্যক্তিটির রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কতটুকু। দেখা যাক, বাল্যকালে যেসব ব্যক্তি এ জীবাণু দ্বারা আক্রান্ত হয়, তাদের ক্ষেত্রে ৯০ শতাংশ লোকের পরবর্তীকালে এ ভাইরাসটি শরীরে দীর্ঘস্থায়ীভাবে বাসা বাঁধে। এ ধরনের রোগীর ৩০ থেকে ৩৫ শতাংশের ক্ষেত্রে এক থেকে চার বছরের দীর্ঘস্থায়ী হেপাটাইটিস-বি রোগে আক্রান্ত হয় এবং এদের ২৫ শতাংশ প্রাপ্তবয়স্ক হওয়ার প্রাক্কালে লিভার সিরোসিস বা ক্যানসারে মারা যায়। যেসব লোক প্রাপ্ত বয়সে হেপাটাইটিস-বি দ্বারা সংক্রমিত হয়, তাদের ৯০ শতাংশ লিভারের জন্ডিস হওয়ার পর ভালো হয়ে যায়। বাংলাদেশের অল্প বয়সেই হেপাটাইটিস-বি দ্বারা আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা বেশি এবং অল্প বয়সে হেপাটাইটিস-বি ভাইরাস দ্বারা আক্রান্ত বেশির ভাগ ব্যক্তিরই জন্ডিসের মতো উপসর্গ থাকে না। ফলে হেপাটাইটিস-বি ও এর দীর্ঘ মেয়াদি জটিলতা নিয়ে রোগীর সংখ্যা বেড়ে যাচ্ছে দিন দিন।   কীভাবে এ জীবাণু ছড়ায় রক্ত ও রক্তজাত পদার্থ হেপাটাইটিস-বি এর বাহক। কোনো ব্যক্তির যদি হেপাটাইটিস-বি ভাইরাস থাকে, তবে এই ভাইরাস দ্বারা সংক্রমিত রোগীর সঙ্গে যৌন সঙ্গম করলে, আক্রান্ত ব্যক্তির রক্ত গ্রহণ করলে, সংক্রমিত রোগীর ব্যবহার করা টুথব্রাশ, ব্লেজার বা ব্লেড ব্যবহার করলে, সংক্রমিত রোগীর কাছ থেকে সুস্থ ব্যক্তির দেহে এ জীবাণু ছড়াতে পারে। ঐতিহ্যগতভাবে সেলুনে ব্যবহূত ক্ষুর বিভিন্ন জনের ব্যবহারকালে হেপাটাইটিস-বি সংক্রমিত হতে পারে। গর্ভবতী মায়ের শরীরে হেপাটাইটিস-বি থাকলে প্রসবকালে নবজাতকের হেপাটাইটিস-বি হওয়ার আশঙ্কা বেশি। তবে সংক্রমিত রোগীর সঙ্গে করমর্দন করলে, হাঁচি দিলে, রোগীর পাশাপাশি বসলে এ ভাইরাস ছড়ায় না।   উপসর্গ বেশির ভাগ ক্ষেত্রে হেপাটাইটিস-বি ভাইরাস রোগীর দেহে বাহক হিসেবে সুপ্ত অবস্থায় থাকে। কোনো ধরনের উপসর্গ দেখা দেয় না বলে এ সংক্রান্ত জটিলতা দেখা না দিলে রোগীরা চিকিৎসকের শরণাপন্ন হন না। কিছু কিছু রোগী সর্দি, জ্বর, দুর্বলতা, খাবারে অরুচি, পেটে ব্যথা, পাতলা পায়খানা নিয়ে চিকিৎসকের কাছে আসতে পারেন। চিকিৎসা ক্ষণস্থায়ীভাবে আক্রান্ত (Acute) রোগীর নির্দিষ্ট কোনো চিকিৎসা দিতে হয় না। এ রোগীকে অন্যদের মতো স্বাভাবিক খাবার দিতে হয়। আমাদের মধ্যে একটি প্রচলিত ধারণা আছে, স্বল্প মেয়াদি জন্ডিস হলে রোগীকে আখের রস, গ্লুকোজ বেশি খাওয়াতে হবে। এ ধারণা সম্পূর্ণ ভিত্তিহীন। কারণ এতে রোগীর পেট ফাঁপা, বমি বমি ভাব ও বমি বেড়ে যায়। দীর্ঘস্থায়ী হেপাটাইটিস-বি প্রদাহের জন্য কয়েকটি খাওয়ার ওষুধ ও ইনজেকশন আছে। তবে এ ওষুধগুলো কোন রোগীকে কত দিন দেওয়া যাবে, তা অবশ্যই পরিপাকতন্ত্র ও লিভার বিশেষজ্ঞের পরামর্শ অনুযায়ী নির্ধারিত হওয়া উচিত। কারণ এ ওষুধ সব রোগীর বেলায় সমানভাবে প্রযোজ্য নয় এবং ওষুধগুলোর কার্যকারিতা, ওষুধ-সংক্রান্ত জটিলতা গভীরভাবে পর্যবেক্ষণের প্রয়োজন রয়েছে। দীর্ঘস্থায়ীভাবে আক্রান্ত রোগীদের ক্ষেত্রে খাওয়ার ওষুধ বা ইনজেকশন দিয়ে চিকিৎসা করা যেতে পারে পরিপাকতন্ত্র বা লিভার বিশেষজ্ঞের পরামর্শ অনুযায়ী। হেপাটাইটিস-বি ভাইরাসে আক্রান্ত ব্যক্তিদের ওষুধ গ্রহণের সঙ্গে নিম্নবর্ণিত উপদেশগুলো পালন করা অত্যন্ত জরুরি ১. খাবার ও পানীয় দ্রব্য গ্রহণে সাবধানতা অবলম্বন করতে হবে। খাবার ও পানীয়ের মাধ্যমে অন্য হেপাটাইটিস যেমন- হেপাটাইটিস-‘এ’ এবং হেপাটাইটিস-‘ই’ শরীরে সংক্রমিত হওয়ার আশঙ্কা থাকে। হেপাটাইটিস-বি’তে আক্রান্ত রোগীর ক্ষেত্রে সাধারণত এ সংক্রান্ত জটিলতা বেশি হয়। ২. পরিবারের অন্যান্য ঘনিষ্ঠজন যাদের সংস্পর্শে আসার সম্ভাবনা বেশি যেমন-স্বামী-স্ত্রী, ভাইবোন, মা-বাবার এইচবিএসএজ পরীক্ষা করে রিপোর্ট নেগেটিভ হলে টিকা নেওয়া উচিত এবং পজেটিভ হলে যথাযথ চিকিৎসার জন্য শিগগিরই পরিপাকতন্ত্র ও লিভার বিশেষজ্ঞের পরামর্শ নেওয়া উচিত। ৩. চিকিৎসকের পরামর্শ ছাড়া কোনো ওষুধ সেবন করা উচিত নয়। ৪. অবশ্যই মদ্যপান ত্যাগ করা উচিত। ৫. পরিপাকতন্ত্র ও লিভার বিশেষজ্ঞের পরামর্শ ছাড়া ওষুধ বা ইনজেকশন ব্যবহার বন্ধ করা উচিত নয়।   প্রতিরোধ আশার কথা, এই ভাইরাসের বিরুদ্ধে ১৯৮২ সালে টিকা আবিষ্কৃত হয়েছে। জন্মের পর পরই অন্যান্য টিকার সঙ্গে হেপাটাইটিস-বি ভাইরাসের টিকা দিতে হবে। উল্লেখ্য, বাংলাদেশেও সম্প্রসারিত টিকাদান কর্মসূচির (ইপিআই) সঙ্গে হেপাটাইটিস-বি টিকা চালু হয়েছে। ঘনবসতিপূর্ণ বাংলাদেশে হেপাটাইটিস-বি রোগীর সংখ্যা বেশি, তাই এইচবিএসএজ, নেগেটিভ সবারই হেপাটাইটিস-বি ভাইরাসের টিকা নেওয়া উচিত। এ রোগের সংক্রমণ রোধকল্পে জনসচেতনতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে সরকারি ও বেসরকারি স্বাস্থ্য প্রতিষ্ঠানগুলোর আরও এগিয়ে আসা উচিত। ডা. এ বি এম ছফিউল্লাহ সহকারী অধ্যাপক, গ্যাস্ট্রোএন্টারোলজি বিভাগ, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেলবিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা সূত্র: দৈনিক প্রথম আলো, মে ১৯, ২০১০   হেপাটাইটিস বি – নতুন করে চেনা ১৯৬৫ সালে এক অস্ট্রেলীয় আদিবাসীর রক্তে হেপাটাইটিস বি ভাইরাস আবিষ্কৃত হয়। বর্তমানে পৃথিবীতে প্রায় ৩৫ কোটি লোক হেপাটাইটিস বি ভাইরাসে আক্রান্ত, যাদের প্রায় এক কোটির বাস বাংলাদেশে। রক্ত আর স্ত্রী-সহবাসের মাধ্যমে এ ভাইরাসটি ছড়ায়। রক্ত ছাড়াও মানুষের লালাতে হেপাটাইটিস বি ভাইরাস পাওয়া যায়। এই ভাইরাসে আক্রান্ত অধিকাংশ লোকের বয়স ৫০ বছরের নিচে। হেপাটাইটিস বি আক্রান্ত কোনো ব্যক্তির রক্তমাখা সু্ইয়ের খোঁচায় ভাইরাসটি সংক্রমণের আশঙ্কা শতকরা ৩০ ভাগ। আর মায়ের রক্তে হেপাটাইটিস বি ভাইরাস থাকলে জন্মের পরপর সন্তানের আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা প্রায় ৯০ ভাগ। তবে মায়ের দুধের মাধ্যমে হেপাটাইটিস বি ভাইরাস ছড়ায় না। সামাজিক মেলামেশা যেমন— করমর্দন বা কোলাকুলি ও রোগীর ব্যবহার্য সামগ্রী গ্লাস, চশমা, তোয়ালে, জামা-কাপড় ইত্যাদির মাধ্যমে এ রোগ ছড়ায় না। হেপাটাইটিস বি ভাইরাসে আক্রান্ত প্রায় ৭০ ভাগ রোগীর জন্ডিসে আক্রান্ত হওয়ার কোনো ইতিহাস থাকে না। শতকরা ১০ ভাগ প্রাপ্তবয়স্ক আর প্রায় ৯০ ভাগ শিশু যারা এ ভাইরাসে আক্রান্ত হয়, তাদের লিভারে স্থায়ী ইনফেকশন দেখা দেয়। একে বলা হয় ক্রনিক হেপাটাইটিস বি। এসব ব্যক্তিই HBsAg পজিটিভ হিসেবে পরিচিত। এ ধরনের রোগীর প্রায়ই কোনো লক্ষণ থাকে না। এরা কখনো কখনো পেটের ডান পাশে ওপরের দিকে ব্যথা, দুর্বলতা কিংবা ক্ষুধামন্দার কথা বলে থাকে। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই বিদেশে গমনের সময় রক্ত পরীক্ষা কিংবা রক্ত দিতে অথবা ভ্যাকসিন নিতে গিয়ে রোগীরা তাদের ইনফেকশনের কথা জানতে পারে। ক্রনিক হেপাটাইটিস বি এশিয়া ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় আরও অনেক দেশের মতো বাংলাদেশেও লিভার সিরোসিস ও লিভার ক্যানসারের প্রধান কারণ। দুর্ভাগ্যের বিষয় হলো, যদিও হেপাটাইটিস বি অনেকাংশেই নিরাময়যোগ্য, কিন্তু অ্যাডভান্সড লিভার সিরোসিস অথবা লিভার ক্যানসারে আক্রান্ত না হওয়া পর্যন্ত রোগীরা প্রায়ই কোনো শারীরিক অসুবিধা অনুভব করে না। ফলে হেপাটাইটিস বি ভাইরাস ইনফেকশনের চিকিত্সা করা সম্ভব হলেও রোগীকে আর সেভাবে সাহায্য করা সম্ভব হয় না। ভ্যাকসিনেশন হেপাটাইটিস বি প্রতিরোধে কার্যকর। হেপাটাইটিস বি ভাইরাসে আক্রান্ত মায়ের সন্তান, রোগীর স্বামী বা স্ত্রী, স্বাস্থ্যকর্মী ও থেলাসেমিয়া এবং অন্যান্য হেমোলাইটিক এনিমিয়ার রোগীদের জন্য হেপাটাইটিস বি-এর ভ্যাকসিন নেওয়া অত্যন্ত জরুরি। তবে ভ্যাকসিনটি নিতে হবে কোনো ভালো জায়গা থেকে। কারণ, ঠিকমতো সংরক্ষণ করা না হলে এই ভ্যাকসিন কোনো উপকারেই আসে না। এর মধ্যেও সুসংবাদ হলো, হেপাটাইটিস বি আজ আর কোনো দুরারোগ্য ব্যাধি নয়। লিভার সিরোসিস বা লিভার ক্যানসারের মতো মারাত্মক রোগ দেখা দেওয়ার আগে এটি ধরা গেলে রোগাক্রান্ত ব্যক্তির পূর্ণ নিরাময়ের সম্ভাবনা খুবই উজ্জ্বল। পৃথিবীতে আজ এই ভাইরাসটির বিরুদ্ধে কার্যকর অনেক ওষুধ রয়েছে, যার প্রায় সবকটিই বাংলাদেশে সহজলভ্য। এসবের মধ্যে আছে পেগাসিস, ইন্টারফেরন, ল্যামিভুডিন, এডিফোভির আর সর্বশেষ সংযোজন টেলবিভুডিন, যা এ বছরের প্রথম দিকে আমেরিকায় ফেডারেল ড্রাগ অ্যাডমিনিস্ট্রেশনের অনুমোদন পেয়েছে, আর এখন বাংলাদেশেও পাওয়া যাচ্ছে। আরও সুসংবাদ হলো, আমাদের দেশীয় একাধিক ওষুধ কোম্পানি এসব ওষুধের বেশ কিছু এ দেশেই তৈরি করছে এবং তা সাধারণের ক্রয়ক্ষমতার মধ্যে। তবে চিকিত্সায় প্রত্যাশিত ফলাফল প্রাপ্তি নির্ভর করে সঠিক সময়ে সঠিক ওষুধ প্রয়োগের ওপর। হেপাটাইটিস বি আক্রান্ত কোনো রোগীকে হেপাটাইটিস বি-এর যেকোনো ওষুধ দিয়ে দিলেই কাজ হয়ে যাবে, এমনটা প্রত্যাশা করা ঠিক নয়। এ জন্য অনেক সময় লিভার বায়োপসি করেও সিদ্ধান্ত নিতে হয়। কারণ, ওষুধ নির্বাচনে কিংবা প্রয়োগে এতটুকু হেরফের হলেও তাতে ভাইরাল রেজিস্টেন্স তৈরির পাশাপাশি রোগীর লিভারের বড় ধরনের ক্ষতির আশঙ্কা থাকে। হেপাটাইটিস বি-জনিত লিভার রোগ প্রতিরোধ ও চিকিত্সায় তাই প্রয়োজন সচেতনতার। একদিকে যেমন প্রত্যেকেরই উচিত হেপাটাইটিস বি-এর ভ্যাকসিন নেওয়া, তেমনি হেপাটাইটিস বি-আক্রান্ত ব্যক্তিরও উচিত হতাশ না হয়ে লিভার রোগবিশেষজ্ঞের শরণাপন্ন হওয়া। লিভারে আক্রান্ত প্রায় ৩০ শতাংশ রোগী পরবর্তী সময়ে লিভার সিরোসিসে আক্রান্ত হয়। এ দেশেও আমরা ফ্যাটি লিভারজনিত লিভার সিরোসিস ও লিভার ক্যানসারের রোগী পেয়ে থাকি। অতএব সাবধান! মামুন-আল-মাহতাব হেপাটাইটিস বি নতুন করে চেনা সহকারী অধ্যাপক, লিভার বিভাগ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় সূত্র: দৈনিক প্রথম আলো, জানুয়ারী ২৭, ২০১০   হেপাটাইটিস সি আমার নাম হেপাটাইটিস সি ভাইরাস। আমি অতি ক্ষুদ্র জীবাণু, একটি আর এন, এ ভাইরাস। আমি অনাদি অনন্ত কাল থেকে মানুষের দেহে বসবাস করে আসছি এবং হেপাটাইটিস সি ভাইরাস জনিত লিভারে রোগ সৃষ্টি করছি। অনাদি কাল থেকে আমি শান্তিতেই ছিলাম। মানুষের দেহে বিশেষ করে লিভারের মধ্যে আমার বসবাস। মানুষের দেহে সর্বাঙ্গে আমি আক্রমণ চালাতে পারি। তবে দেহের লিভার যন্ত্রটি আমার খুবই প্রিয় বাসস্থান। আমার নাম দীর্ঘকাল ধরে মানুষের নিকট অজ্ঞাত ছিল। আমার পরিচয় ছিলনা বলে ১৯৮৯ সালের আগ পর্যন্ত আমাকে ডাকত নন এ নন বি ভাইরাস হিসাবে। কিন্তু মানুষের চেষ্টার কোন সীমা নাই। দীর্ঘদিন চেষ্টা প্রচেষ্টার পর মাত্র কয়েক বছর আগে মানুষের যন্ত্রের জালে আমি ধরা পড়ে যাই। আমেরিকার কিরন কর্পোরেশন আমাকে ধরে ফেলে। তাদের জালে আটকা পড়ার পর আমার নামকরন করা হয় হেপাটাইটিস সি ভাইরাস। আমি মানুষের কোষের ভিতরে বাস করি। আমার আয়তন মাত্র ৫০ ন্যানোমিটার। আমাকে সাধারণ মাইক্রোসকোপ দিয়েও দেখা যায় না, খালি চোখে তো দেখার প্রশ্নই ওঠে না। কেবল মাত্র ইলেকট্রন মাইক্রোসকোপ দিয়ে আমাকে দেখা যায়। আমি একজন সিঙ্গেল স্ট্র্যান্ডেড আর এন এ ভাইরাস। আমার আকার ছোট হলে কি হবে মানুষের ক্ষতি করতে আমার জুড়ি নেই। আমি কিভাবে মানুষকে আক্রমণ করি তা জানলে আপনারা যদিও সাবধান হয়ে যাবেন তবুও বলেই ফেলি। আমি প্রধানতঃ সংক্রমিত রক্তের মাধ্যমে অন্য মানুষের শরীরে প্রবেশ করি। বহু ব্যবহৃত সংক্রমিত ইনজেশনের সুঁচ, বিভিন্ন অপারেশনের এবং দাঁতের চিকিৎসার জন্য ব্যবহার করা যন্ত্রপাতি, অনিরাপদ অনৈতিক শারীরিক সম্পর্ক, সেলুনের ক্ষুর, কাঁচি, ইত্যাদি আমি আমার নিজের বিস্তারের জন্য ব্যবহার করে থাকি। তবে দুঃখের বিষয়, খাবার ও পানির মাধ্যমে আমি মানুষকে কাবু করতে পারি না। পাকস্থলীর এসিড আমার শক্র, ওটা আমাকে ধ্বংশ করে দেয়। তাছাড়া মায়ের বুকের দুধের মাধ্যমেও শিশুর শরীরে বংশ বিস্তারের সুযোগ করতে পারিনা। মানুষের শরীরে যে ভাবেই প্রবেশ করিনা কেন, সংগে সংগেই কিন্তু রোগের লক্ষন প্রকাশ করাতে পারিনা। ১৫-১৫০ দিন পার করে তারপর নিজেকে মেলে ধরার চেষ্টা করি। একবার মানুষের শরীরে ঢুকলে আমাকে বের করা অত সহজ নয়। লোকে বলে আমার স্বভাব চরিত্র নাকি খুবই খারাপ। আমি নাকি নীরব ঘাতক। আমি বহুরূপী, বেঁচে থাকার জন্য আমি সাধ্যাতীত চেষ্টা চালাই। শরীরের প্রতিরোধ ক্ষমতা দিয়ে আমার বিরুদ্ধে অ্যান্টিবডি তৈরী হয় বটে, কিন্তু আমার এ বহুরূপী চরিত্রের কারনে আমি নিজেকে বদলে ফেলি। এবার আমাকে পায় কে। আমার বিরুদ্ধে তৈরীকরা প্রতিরোধক টিকাও তাই ব্যার্থ হয়েছে। পৃথিবীতে আমি অন-ত সাড়ে সাত কোটি মানুষের দেহে বসবাস করছি। আমি মানুষের লিভারকে আমার আগুনে পুড়ে পুড়ে ছাই করি। তাদের লিভারকে তিলে তিলে ধ্বংশ করি। মানব দেহে প্রবেশের পর শতকরা ৮৫-৯০ ভাগ মানুষের শরীরেই দীর্ঘমেয়াদি রোগ ক্রনিক হেপাটাইটিস সি রূপে আমার কার্যক্রম চালিয়ে যাই। আমার দীর্ঘমেয়াদি সফলতা আসে মূলত ১২-২০ বছর পর। যদিও সময় লাগে অনেক, কেউ জানতেই পারে না যে আমি ঠিকই দীর্ঘসময় লিভারে প্রদাহ করে যাচ্ছি। তাই আমাকে অনেকে বলে আমার আগুন তুষের আগুন। আঙ্গুল দিলে পুড়ে যায়, দেখা যায় না। আমার আগুনে যখন লিভার জ্বলতে থাকে। তখনও মানুষ বুঝতে পারে না, কি অসুখ হয়েছে তার। অথচ এরই মধ্যে আমি শতকরা ২০ ভাগ মানুষের লিভারে সিরোসিস ঘটিয়ে দিয়েছি। আমি আস্তে আস্তে মানুষের শরীরকে দুর্বল করে দেই। শরীর থাকে ক্লান্ত পরিশ্র্নত, আস্তে আস্তে শরীর ভেঙ্গে যায়, ক্ষুধা মন্দা হয়, হজমে গন্ডগোল হয়, ঘুমের ব্যাঘাত ঘটে। এক সময় জন্ডিস দেখা দেয়, এমনকি পায়ে এবং পেটে পানিও আসতে পারে। এমনটি যখন হয়, তখন আমার আনন্দের সীমা থাকে না। কারণ তখন আমি তার লিভারে বংশ বৃদ্ধি করে চলেছি। আমাকে আর তাড়ায় কে! আমি তখন সাকসেসফুল্লি কার্য সমাধা করে মানুষের লিভারে সিরোসিসের জন্ম দিই। এতেই আমি শান্ত হইনা। এই অবস্থা চলতে থাকলে আমার আক্রমণে মানুষ লিভারের ক্যান্সারে আক্র্নত হতে পারে। যার হার বছরে শতকরা ১-৪ ভাগ পর্যন্ত। এতক্ষন তো বললাম আমার সুখের কথা, এবার আমার দুঃখের কথা শুনবেন কি? আমার দুঃখ রাখার জায়গা নেই। এ দুঃখ আর হতাশার পাল্লা দিন কে দিন ভারি হচ্ছে। যদিও এসব বলে ক্ষতি ছাড়া লাভ নাই তবুও বলি। মানুষ আজকাল বড়ই চতুর আর সচেতন হয়ে গেছে। আমাকে মারার জন্য এরা উঠে পড়ে লেগেছে। আমার অস্তিত্ব বিলীন করার জন্য রিবাভিরিন এবং অত্যন্ত ব্যয়বহুল ইন্টারফেরন দিয়ে চিকিৎসার ব্যবস্থা করেছে। ভাবুনতো কি সাংঘাতিক ব্যাপার। আমার উপস্থিতি এবং কার্যক্রম ধরে ফেলার জন্য বিভিন্ন রকম পদ্ধতি আবিষ্কার করেছে। আমার সংক্রমণের পথ রুদ্ধ করে দিচ্ছে। কারণ পরিষ্কার সুঁই আর বিশুদ্ধ রক্ত ব্যবহার করার ফলে মানুষের শরীরে ঢুকতে পারি না। তবে আমার গতিপথে বাধা দেয়ার ক্ষমতা মানুষ পরিপূর্ণ ভাবে অর্জন করে নেই। যেমন, আমি নাপিতের ক্ষুর, খতনা, টাট্টু, ডেন্টাল প্রসিডিউর, অনৈতিক পরস্পর শারীরিক সম্পর্ক এর মাধ্যমে এখনও বিস্তারের সুযোগ পাই। এখন পৃথিবীর বুকে শতকরা ০.৩-৫ ভাগ মানুষের দেহে আমার শিকড় বিস্তার করে আছি। চারিদিকে আমার বিরুদ্ধে যেভাবে প্রচার প্রপাগান্ডা শুরু হয়েছে তাতে আবার অস্তিত্বই বিলীন হওয়ার আশংকা দেখা দিয়েছে। সামনে মনে হচ্ছে সমূহ বিপদ। কি আর করা, সবই আমার কপাল। আজ তা হলে আসি, আবার দেখা হবে কি? অধ্যাপক লিভার বিভাগ, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয় শাহবাগ, ঢাকা, বাংলাদেশ সূত্র: দৈনিক ইত্তেফাক, ডিসেম্বর ২৬, ২০০৯   হেপাটাইটিস ই প্রতিরোধে দরকার সচেতনতা লিভারের প্রদাহকে হেপাটাইটিস বলা হয়। বিভিন্ন কারণে ভিন্ন ভিন্ন দেশে হেপাটাইটিস হয়ে থাকে। এর মধ্যে ভাইরাস, মদ্যপান, বিপাকের অসংগতি ইত্যাদি। বাংলাদেশে সাধারণত এ, বি, সি, ডি, ই ভাইরাসের মাধ্যমে লিভারের প্রদাহ বা হেপাটাইটিস হয়ে থাকে। জন্ডিস দেখা দিলে এ রোগটি ধরা যায়। যদিও নিশ্চিত হওয়ার জন্য রোগীর রক্তের সিরামে এ ভাইরাসের নির্দিষ্ট অ্যান্টিজেন বা অ্যান্টিবডি উপস্থিত নিশ্চিত করতে হয়। হেপাটাইটিস ‘ই’ জন্ডিস হিসেবে ধরা পড়ে। আপনাআপনি রোগী ভালো হয়ে যেতে পারে এবং পরবর্তী সময়ে সাধারণত রোগটি দীর্ঘ স্থায়ী হয় না। গর্ভবতী মায়েরা ‘ই’ ভাইরাসে আক্রান্ত হলে এর ব্যাপকতা একটু বেশি হতে পারে। হেপাটাইটিস ই উন্নয়নশীল দেশগুলোতে যখন বন্যা বা ভারী বৃষ্টি হয় অথবা বিশুদ্ধ পানির অভাব দেখা দেয়, তখন রোগটি মহামারি বা বিচ্ছিন্নভাবে দেখা দিতে পারে। শিশুদের তুলনায় বয়স্ক ব্যক্তিরা এ রোগে বেশি আক্রান্ত হয়। উন্নয়শীল দেশগুলোতে সুষ্ঠু স্যানিটেশনের অভাব, অপরিকল্পিত বা দুর্বল বর্জ্য ব্যবস্থাপনাই এ রোগ বিস্তারের অন্যতম কারণ। পানিবাহিত এ রোগটি মূলত পায়খানার মাধ্যমে ছড়ায়। দূষিত পানি বা খাবারের মাধ্যমে এ রোগ ছড়িয়ে পড়লে রোগটি মহামারি আকার ধারণ করতে পারে। বাংলাদেশে বিশেষ করে শহরাঞ্চলে গরমের সময় তৃষ্ণার্ত হয়ে মাঝেমধ্যে আমরা ফুটপাতের জুস, শরবত বা ফলের রস পান করে থাকি। যদি এই ফলের রস বা পানিতে হেপাটাইটিস-ই ভাইরাস থাকে, তাহলে এই রস, পানি বা খাবার গ্রহণের মাধ্যমে রোগটি সংক্রমিত হতে পারে। এ ছাড়া দূষিত খাওয়ার পানি, আধাসেদ্ধ শাকসবজি ইত্যাদির মাধ্যমে এটি ছড়াতে পারে। রোগটি শুরু হওয়ার তিন থেকে আট সপ্তাহ পর্যন্ত সুপ্ত অবস্থায় থাকতে পারে এবং সাধারণত দীর্ঘস্থায়ী হয় না। রোগটি হঠাৎ করে বিচ্ছিন্নভাবে বা মহামারি আকারে ব্যাপক এলাকায় ছড়িয়ে পড়তে পারে। ১৫ থেকে ৪০ বছর বয়সী ব্যক্তিরা এ রোগে বেশি আক্রান্ত হয়। শিশুদের ক্ষেত্রে কোনো লক্ষণ ছাড়াও এ রোগ দেখা দিতে পারে। বয়স্ক ব্যক্তিদের ০·৫ থেকে তিন শতাংশ মারা যেতে পারে, গর্ভবতী মায়েদের ১৫ থেকে ৩০ শতাংশ ক্ষেত্রে এ রোগের জটিলতায় গর্ভস্থ শিশু বা মায়ের মৃত্যু, গর্ভপাত, অপরিপক্ব শিশুর জন্ম বা প্রসবের সময় নবজাতকের মৃত্যু হতে পারে। লক্ষণঃ রোগটি বিভিন্নভাবে প্রকাশ পেতে পারে। বেশির ভাগ জন্ডিস, খাবারে অরুচি, পেটে ব্যথা, বমি বমি ভাব কিংবা বমিসহ অল্প জ্বর প্রভৃতি উপসর্গ থাকতে পারে। এ ভাইরাসে আক্রান্ত হলে প্রথম দিকে অল্প অল্প জ্বর, পেটে ব্যথা, বমি বমি ভাব হওয়া, মাটির রঙের মতো মল, গাঢ় প্রস্রাব ও শারীরিক দুর্বলতা দেখা দেয়। পরবর্তী সময়ে জন্ডিস বেশি হলে প্রথম দিকের উপসর্গগুলো কমে যায়। হেপাটাইটিস ‘ই’র এখনো কোনো টিকা আবিষ্কৃত হয়নি। অ্যান্টিবায়োটিক ব্যবহারে সাধারণত লাভ হয় না। তাই এ রোগ প্রতিরোধের জন্য বিশুদ্ধ পানি পান, বিশেষ করে শহরাঞ্চলের অধিবাসীদের পানি ফুটিয়ে পান ও ব্যবহার করা, ব্যক্তিজীবনে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা রক্ষা করা, সুষ্ঠু বর্জ্য ব্যবস্থাপনার ব্যবস্থা করা, ফুটপাতের খাবার না খাওয়া প্রভৃতি মেনে চলা দরকার। ডা· এ বি এম ছফিউল্লাহ সহকারী অধ্যাপক গ্যাস্ট্রোএন্টারোলজি বিভাগ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় সূত্র: দৈনিক প্রথম আলো, এপ্রিল ০১, ২০০৯   জন্ডিসের ভ্যাকসিন কেন দেবেন হেপাটাইটিস এ এবং হেপাটাইটিস বি দু’টি সংক্রামক রোগ। হেপাটাইটিস এ বা সাধারণ জন্ডিস সাধারনত: খাবার পানি বাইরের খোলা ও জীবানুযুক্ত খাবার আহার করলে এবং আক্রান- ব্যক্তির সংস্পর্শে আসলে অথবা আক্রান- ব্যক্তির ব্যবহার্য জিনিসপত্র ব্যবহার করলে হেপাটাইটিস এ বা সাধারণ জন্ডিস সংক্রমিত হতে পারে। সাধারনত: বিশ্রাম ও কিছু নিয়ম-নীতি মেনে চললে হেপাটাইটিস এ ভালো হয়। হেপাটাইটিস এ জন্ডিসের বিরুদ্ধে কার্যকর ভ্যাকসিন। দু’টি ভ্যাকসিন দিয়ে হেপাটাইটিস এ রোধ করা যায়। আর এক ধরনের জন্ডিস হচ্ছে হেপাটাইটিস বি। হেপাটাইটিস বি ভাইরাস থেকে এই রোগ সংক্রমিত হয়। জীবানুযুক্ত ইনজেকশনের সূই ব্যবহার জীবানুযুক্ত রক্ত সঞ্চালন, আক্রান- ব্যক্তির সঙ্গে শারীরিক সম্পর্ক এই রোগ সংক্রমনের প্রধান কারণ। এই রোগের বিরুদ্ধে কার্যকর ভ্যাকসিন রয়েছে। ৪টি ভ্যাকসিন দিয়ে হেপাটাইটিস বি প্রতিরোধ করা যায়। তবে ভ্যাকসিন দেয়ার ক্ষেত্রে সবচাইতে উন্নতমানের কার্যকর ভ্যাকসিন দিতে হবে, কমদামের অননুমোদিত ভ্যাকসিন দিবেন না। জেনে নেবেন ভ্যাকসিন ওষুধ প্রশাসনের অনুমোদিত কিনা। সব সময় মনে রাখবেন অনেক অসাধু ব্যবসায়ী মুনাফা লাভের আশায় অকার্যকর কমদামী ভ্যাকসিন বাজারজাত করছে। এসব ভ্যাকসিন শরীরে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা তৈরী হয় না। সূত্র: দৈনিক ইত্তেফাক, ফেব্রুয়ারী ২০, ২০১০

মন্তব্যসমূহ

জনপ্রিয় পোস্টসমূহ